এই আধুনিক যুগে ঘরে ঘরে ম্যাসাজথেরাপির প্রয়োজন

শংকরশ্রী সুদীপ্ত বিশ্বাস,যোগা এ্যান্ড ফিজিওথেরাপিষ্ট,
 
( সম্পাদক ,রাজদীপ পত্রিকা,
পরিচালক : অভিজ্ঞান যোগা এন্ড ফিজিওথেরাপি সেন্টার , স্থাপিত: ২০০০, শ্রীরামপুর, হুগলী,
 পশ্চিমবঙ্গ, ভারতবর্ষ।
ফোন ও হোয়াটসঅ্যাপ : 8777857004 , 9830715997 & 9051357223)
-----------------------------------------------------------------------
 ফিজিওথেরাপি কথাটা এখন বহু প্রচলিত কিন্তু ফিজিওথেরাপি সম্পর্কে অনেকেরই ধারণাটা তেমন পরিষ্কার নয়। ফিজিওথেরাপির প্রকৃত অর্থ হলো ট্রিটমেন্ট বাই ফিজিক্যাল মিন্স ------- অর্থাৎ ফিজিওথেরাপি মানে ভৌত চিকিৎসা। যে চিকিৎসাতে কোন ওষুধ বা ইনজেকশন দরকার হয় না । উপকরণ হিসেবে লাগে কতগুলো ভৌত অর্থাৎ প্রাকৃতিক উপাদান থেকে উৎপাদিত শক্তি। কি কি সেই ভৌত উপাদান ? এর উত্তরে বলা যায় :------ জল ,বায়ু, বিদ্যুৎ, তাপ ও শারীরিক শক্তি মূলত:  এগুলোর সাহায্যেই এই ধরনের চিকিৎসা করা হয়।

## প্রাচীনকালেও ফিজিওথেরাপির অস্তিত্ব :---------

ষোড়শ শতাব্দীতে ফ্রান্সের বিখ্যাত চিকিৎসক এ্যামব্রোইস পোরে , সুইডেনের বিখ্যাত জিমন্যাস্ট 
'লিং ' যাকে  father of therapeutic massage বলা হয় তিনি এবং আমেরিকার মাসাজথেরাপিস্ট জর্জ ডাউনিং---------এনারা সবাই ফিজিওথেরাপির একটি জনপ্রিয় শাখা ম্যাসাজথেরাপির ওপর যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছিলেন। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে ঋষি পুত্র আত্রেয় এবং সুশ্রুত (যিনি ঋষি বিশ্বামিত্রের পুত্র ছিলেন) ্্ এনারা যে আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা করতেন তাতেও ফিজিওথেরাপির একটি অঙ্গ মালিশ বা মর্দনের ব্যবস্থা ছিল। একটু পরবর্তীকালে চরক সংহিতাতেও ঐ ধরনের পরিচয় পাওয়া যায়।

## ম্যাসাজথেরাপি কি ?

গ্রিক শব্দ 'মেশিন' থেকে ম্যাসাজ কথাটি এসেছে ।যাকে বাংলায় মর্দন বা মালিশ বলা হয়। কিন্তু চিকিৎসা শাস্ত্রে মর্দন বা ম্যাসাজ বিজ্ঞানগত ভিত্তিতে সাধারণ 
ম্যাসাজের তুলনায় ভিন্ন ধরনের হয় । শিক্ষিত- অশিক্ষিত বহু লোক সাধারণভাবে ম্যাসাজ করতে সক্ষম হন যাকে ম্যাসাজথেরাপি আখ্যা দেওয়া উচিত নয়। থেরাপি ভিত্তিক বা থেরাপিউটিক ম্যাসাজ করতে হলে ম্যাসাজকারীকে শরীরের বিভিন্ন পেশী, শিরা, ধমনী , রিফ্লেক্সপয়েন্ট, হাড়ের গঠন ,রক্ত সঞ্চালন পদ্ধতি প্রভৃতি বিষয় সম্পর্কে যথেষ্ট শিক্ষা প্রাপ্ত হতে হয় এবং সেই শিক্ষার ভিত্তিতে শরীরের সুনির্দিষ্ট জায়গায় সুনির্দিষ্ট  বিভিন্ন পদ্ধতিতে ম্যাসাজ করে অসুস্থ লোককে আরোগ্য লাভে সহায়তা করতে হয়।

## শরীর ও মনের ক্ষেত্রে ম্যাসাজ কিভাবে উপকার করে ?

ম্যাসাজথেরাপি হলো এক ধরনের পরোক্ষ ব্যায়াম (Passive exercise)। এই থেরাপিতে শরীরের বিভিন্ন গ্রন্থি (Gland) সঠিকভাবে কাজ করে স্নায়ুতন্ত্রের সঞ্চালন, রক্ত সঞ্চালন ও দেহের ভেতরকার বিভিন্ন তরল পদার্থের সঞ্চালনে ভারসাম্য বজায় রাখে। পেশীর সঞ্চালন ক্ষমতা অনেক বেশি বাড়িয়ে দিয়ে ঢিলেঢালা দুর্বল পেশীকে সবল করে তোলে। ম্যাসাজের মাধ্যমে যেহেতু অস্থিসন্ধের সঞ্চালন ক্ষমতা অনেক বেশি বাড়ে তাই  গাঁটে গাঁটে যন্ত্রনার ক্ষেত্রে ম্যাসাজ প্রভূত উপকার করে ।এই কারণে ম্যাসাজকে natural pain killer বলা হয়। শরীরের যেসব জায়গায় দরকার ম্যাসাজ সেখানে অক্সিজেন বহন করে নিয়ে যায় , ব্লাড প্রেসারকে নরমাল রাখে, শরীরের ভেতরের বর্জ্য পদার্থকে বের করে দিতে সাহায্য করে, উৎকণ্ঠা, টেনশন, ডিপ্রেশন অনেক কমায়,  শ্বাস- প্রশ্বাসের গতিতে সুনিয়ন্ত্রিত রাখে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে তোলে । সর্বোপরি ম্যাসাজথেরাপি নিয়মিতভাবে করালে শরীর সম্পূর্ণ ভাবে রিলাক্সড থাকে।

##  ম্যসাজথেরাপি  দ্বারা যেসব রোগ নিরাময় হয় তা হল :--------

১)নার্ভের অসুখ ২) অনিদ্রা   ৩) পেশীর নানা সমস্যা,
৪)নানা ধরনের বাত ৫) প্যারালিসিস ৬) সেরিব্রাল অ্যাটাকের পর  ৭) শ্বাসকষ্ট  ৮) হাইপ্রেসার ৯)  ব্লাড সুগার ১০) স্পন্ডিলাইটিস ১১) আলস্য ভাব ১২)  মানসিক অবসাদ১৩)  হাইপারটেনশন ১৪) মাথাধরা বা মাথার যন্ত্রণা ১৫)  সর্দি-কাশি ১৬) সাইনুসাইটিস ১৭) ভেরিকোজ ভেইন প্রবলেম ১৮) কোষ্ঠকাঠিন্য ১৯) কোমরের বা কাঁধের হাড়ে ব্যথা হওয়া ২০) বিভিন্ন স্ত্রীরোগ ২১) ট্যলীপিস (পায়ের পাতা ডিফেক্ট) ২২) রক্তে ইউরিক এ্যাসিডের বৃদ্ধি প্রভৃতি া  

## সুস্থ লোকেদের ক্ষেত্রে আজীবন নীরোগ থাকার জন্য ম্যাসাজথেরাপির প্রয়োজন :----------

যেহেতু ম্যাসাজ দ্বারা অনেক রোগের আরোগ্য হয় তাই অনেকেরই ধারণা যতক্ষণ না দেহ রোগাক্রান্ত হচ্ছে ততক্ষণ ম্যাসাজের প্রয়োজন নেই। কিন্তু এটি ভুল ধারণা। বিজ্ঞানী , চিকিৎসক, খেলোয়াড়, রাজনীতিবিদ, ব্যস্ত এক্সিকিউটিভ, শিক্ষাবিদ ,লেখক, কবি, কালচারাল অ্যাক্টিভিস্ট ,social activist, শিল্পী ,ব্যবসায়ী, চাকুরীজীবী,  বডিবিল্ডার ,ওয়েটলিফটার ,গবেষক, অভিনেতা -অভিনেত্রী,  গৃহবধূ ,ছাত্র-ছাত্রী প্রভৃতি স্তরের অধিকাংশ লোকই একটা সময় পর্যন্ত শারীরিক ও মানসিকভাবে নানা যোগ্যতার অধিকারী হয়। কিন্তু এই যোগ্যতাকে বহু বছর ধরে রাখার জন্য ম্যাসাজথেরাপি করাতে থাকলে বুদ্ধিমানের কাজ হয়। 

##  ফিজিক্যালি চ্যালেঞ্জড এ্যান্ড পার্টলি মেন্টালি retarded পার্সেনদের নবজীবন লাভে ম্যাসাজথেরাপির অনন্য ভূমিকা :---------

বিভিন্ন রোগের আক্রমণে , দুর্ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে  সুস্থ সবল মানুষ যখন হঠাৎ প্রতিবন্ধী হয়ে যান  তখন ম্যাসাজথেরাপি তাদের আবার কর্মোপযোগী করে তোলে এবং অনেকটাই প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে মুখের হাসি ফোটাতে পারে।

## শিশুর জন্য ম্যাসাজ :---------

বয়স্কদের জন্য ম্যাসাজথেরাপি উপকারী। শিশুর ক্ষেত্রে তার চেয়ে বেশি উপকারী ।নিয়মিত ম্যাসাজথেরাপি করালে শিশুর লিভার ,পাকস্থলী, ব্রেন , স্নায়ুতন্ত্রের শক্তি, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ও চামড়া অত্যন্ত ভালো থাকে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে এই দূষণের যুগেও শিশু ঝট  করে রোগের কবলে পড়েনা । নিউজিল্যান্ড, আলাস্কা , ইউনাইটেড স্টেটস প্রভৃতি দেশে  শিশু ম্যাসাজের গুরুত্ব অপরিসীম। ভারতেও অতীতকাল থেকে এখনো পর্যন্ত অপ্রশিক্ষিত মায়েরা কিংবা আয়ারা স্নানের আগে তেল দিয়ে আনাড়িভাবে যে ম্যাসাজ করেন তাতে উপকার খুব কমই হয়। বরং অনেক ক্ষেত্রে অপকার হয়। এর জন্য সুশিক্ষিত ম্যাসিওর বা ম্যাসাজকারী দরকার।

##  বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মতে ম্যাসাজথেরাপির ভূমিকা :----

ভারতের জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত অর্থপেডিক সার্জন কলকাতার প্রাক্তন শেরিফ ডাক্তার ফুটবল সম্রাট 'পেলে'-র একসময়ের চিকিৎসক  ডাক্তার সুনীল ঠাকুর বলেছেন, " আমার দীর্ঘ চিকিৎসক জীবনের অভিজ্ঞতায় দেখেছি অনেক সময় ফিজিওথেরাপি তথা ম্যাসাজথেরাপি রোগীর দেহে ম্যাজিকের মতো কাজ করে। " 

আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব শরীরচর্চা জগতের প্রবাদ পুরুষ বিশ্বশ্রী মনতোষ রায়ের মতে, " যখন আমরা মর্দন ও ঘর্ষণের মধ্যে দিয়ে তেল মালিশ করে অতিরিক্ত তাপ সৃষ্টি করি ,তখন স্নায়ু ও শরীরের অন্যান্য যন্ত্রগুলি এমনভাবে কাজ করতে শুরু করে, যা শরীরের অতিরিক্ত তাপকে সহজে বের করে দিতে সাহায্য করে ঘামের মধ্যৈ দিয়ে ........" 




এতক্ষণের আলোচনার ভিত্তিতে এটুকু বোঝা গেল যে, আধুনিক ব্যাপক অসুস্থতার যুগে ম্যাসাজথেরাপি সকলের পক্ষেই কম বেশি প্রয়োজনীয়। তবে এক্ষেত্রে এটাও মনে রাখা প্রয়োজন যে, ফিজিওলজি, এ্যানাটমি ও ম্যাসাজথেরাপি সম্পর্কে যথেষ্ট অভিজ্ঞ লোকেদের দিয়ে ম্যাসাজ করানো উচিত । তা না হলে ম্যসাজ সম্পর্কে ভুল ধারণা তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।

                     --------------০----------------




Comments